এম. এ. মুইদ হোসেন আরিফ:
ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাঞ্চল্যকর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে সক্রিয় ছিলো একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র।
জানা গেছে, সিভিল সার্জনের এই নিয়োগে ১২৯টি পদের বিপরীতে ৩ ধাপে মোট ২৫ হাজার ২০ জন প্রার্থী আবেদন করেন। যার মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে ৯ হাজার ৬২২ জন। এর মধ্যে লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ৭১০ জন। সর্বশেষ বিভিন্ন নাটকীয় ভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে নিয়োগ কমিটি তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে কিছু প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো পারফর্ম করা প্রার্থীদের বাদ দিয়ে কম নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকায় রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
এরই মধ্যে লিখিত পরীক্ষার খাতা ও ভাইবার ফলাফল পুনঃনিরীক্ষনের জন্য ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ডের এক প্রার্থী আবেদনও করেছেন। কিছু প্রার্থী অভিযোগ করেন মৌখিক পরীক্ষায় তাদের ঠিকভাবে প্রশ্নই করা হয়নি। কোন কোন প্রার্থী ১০ থেকে ১৫ টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে এবং কোন কোন প্রার্থী ১ থেকে ৩ টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে। দেখা গিয়েছে কম প্রশ্নের সঠিক উত্তরদাতার চাকরি হয়েছে। যারা বেশি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে তাদের করো চাকরি হয়নি মর্মে জানান ভুক্তভোগী প্রার্থীরা।
নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী প্রার্থী বাছাইয়ের ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। বিশেষ করে রাজধানীকেন্দ্রিক একটি চক্র বিভিন্ন ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষায় অন্যজনের হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পরিচিত, এবার ফরিদপুরেও সক্রিয় ছিলো।
জানা গেছে, এই চক্রটি জনপ্রতি ২ লাখ টাকার বিনিময়ে কয়েকজন পরীক্ষার্থীর পক্ষে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং উত্তীর্ণও হয়। কিন্তু ভাইভা বোর্ডে তাদের একজন ‘প্রক্সি পরীক্ষার্থী’ ধরা পড়ে যায়। এরপর বাকিরা আর ভাইভায় অংশ নেয়নি। ধৃত ব্যক্তি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলেও, একটি প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক তাকে রক্ষা করতে সক্রিয় ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। এছাড়া, সিভিল সার্জন অফিসের ভেতরের একটি গ্রুপের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, লিখিত পরীক্ষা শেষে উত্তরপত্র জমা দেওয়ার সময় বাইরে থেকে তৈরি করা খাতা, কৌশলে জমাকৃত খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে হলের উপস্থিতি খাতাতেও জাল স্বাক্ষরের মাধ্যমে অনুপস্থিত প্রার্থীদের উপস্থিত দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত হলে অভিযোগের সত্যতাও মিলে। তবে এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা এখনো অজানা। মজার বিষয় শতজনের অধিক লোকদিয়ে মহাযঞ্জ করে খাতা দেখে তরিগরি পাতানো ফলাফল প্রকাশ করে। তাৎক্ষনিক মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড তৈরি করে, যেখানে পাঁচজন একই টেবিলে বসে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও তারা তরিগরি করে প্রথম তালা ও দ্বিতীয় তলায় পৃথক পৃথকভাবে দুইটি ভাইবা বোর্ডে ভাইবা নেয়। তাতে অনেকেরি সন্দেহের সৃষ্টি হয়। নির্ধারিত এলাকার যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অন্য ওয়ার্ডের প্রার্থীদের ভাইভায় উত্তীর্ণ দেখিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে। যদিও বোর্ডে পাঁচজন সদস্য থাকায় তদবির তেমন কাজ করেনি বলেই দাবি করা হচ্ছে, তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির তদবির ছিল বলে জানায় অফিসের এক কর্মকর্তা। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১২৯টি পদে নিয়োগ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব পদ শূন্য থাকায় হাজারো প্রার্থী অংশ নিয়েছে। এমনকি ২০১৮ সালের আবেদনকারীরাও রয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার প্রেক্ষিতে সিভিল সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নিয়োগ প্রক্রিয়াকে শতভাগ স্বচ্ছ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তার দাবি, নিয়োগে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জানানো হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির জন্য আলোচিত। নিয়োগ প্রক্রিয়ার পর্দার আড়ালে আর কী কী অনিয়ম হয়েছে, তা খোলাসা না হলে জনমনে সন্দেহ থেকেই যাবে। এদিকে নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাধারণ প্রার্থীরা। তারা নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। ফরিদপুরের সচেতন মহল মনে করেন, এই ধরনের অনিয়ম সরকারি নিয়োগ ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর অন্যতম কারণ হতে পারে। তারা দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা কিছু পরীক্ষার্থীর গড়মিলা পেয়েছি। গড়মিলের বিষয়ে সন্দেহ হওয়ায় তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে আমি নিয়োগ প্রক্রিয়া শতভাগহ স্বচ্ছ রাখার জন্য চেষ্টা করেছি। যদি কোন ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয় তাহলে আমাদের দেওয়া নির্দেশানার ৮নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
একধিক বিশ্বস্ত মাধ্যমে জানা যায়, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পদের অনুকুলে ভাইবা বোর্ডের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। যা ভাইবা বোর্ডের সদস্যদের মাধ্যমে ভাগাভাগি হয়েছে। এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক আবু জাফর এর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।