Sonaly Khobor

মনিরুজ্জামান মনির :

‘আপনি সিসিটিভি নজরদারির আওতায় রয়েছেন।’ অফিসের সব দেয়াল ও পিলারে সাঁটানো রয়েছে এসব সতর্কবাণী। অফিসকে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত রাখতে এমন উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবচিত্র ঠিক উল্টো।
ঢাকা মহনগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ন কোতোয়ালী রাজস্ব সার্কেল এসিল্যান্ড অফিস ঘুষ-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র। তারা দীর্ঘদিন ধরে জনসাধারণের কাছ থেকে জমির নামজারি ও জমাভাগ বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কতৃর্পক্ষের নজরদারির অভাবে চক্রটি এখন বেপরোয়া। দালাল ছাড়া ফাইল লড়ে চড়ে না। তহশিল অফিসগুলো থেকে এসিল্যান্ড অফিসে শত শত খারিজের প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর মধ্যে মাসে বহু নথি অনুমোদন হয়। এই অনুমোদনপ্রাপ্ত নথিগুলো থেকে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন হারে ঘুষ আদায় করেন। পরে তা পদ অনুযায়ী ভাগ-বাটোয়ারা হয়।
এসিল্যান্ড থেকে পিয়ন সবাই যেন এক আত্মা। পিওন থেকে শুরু করে এসিল্যান্ড সকলেই সেই টাকা নেন ভাগাভাগি করে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঘুষ এখন ডিজিটাল প্রতারণায় পরিনত হয়েছে। এসব অভিযোগে সরেজমিনে এমন তথ্য মিলেছে। আর এই ঘুষ বাণিজ্য চক্রের মাষ্টারমাইন্ড সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) কোতোয়ালী সাদিয়া বিনতে সোলয়মান। ঘুষখোর দুর্নীতি পরায়ন এসিল্যান্ড সাদিয়া কোতোয়ালি রাজস্ব সার্কেলে যোগদান করে এক শক্তিশালী ভূমি খাদক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগে জানা যায়। এই সিন্ডিকেট এর কাছে সাধারণ ভূমি মালিকগণ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ঘুষখোর এসিল্যান্ড সাদিয়া এতটাই বেপরোয়া যে, কোনভাবেই তার ঘুষ বাণিজ্য থামানো যাচ্ছে না। সেবা দেওয়ার নামে হর হামেশা চলছে সাদিয়া সিন্ডিকেটের ঘুষবাণিজ্য। সাম্প্রতিক জনপ্রিয় অন্তবর্তীকালীন সরকারের শতভাগ ভূমি সেবা নিশ্চিতকরণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও কোন নির্দেশনা তোয়াক্কা করে না চক্রটি। তথ্যসূত্র মতে, দীর্ঘদিন যাবত কোতোয়ালী এসিল্যান্ড অফিসে কর্মরত এই ভূমি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা ও উমেদারদের ঘুষ বাণিজ্য ও টাকা গণনা ওপেন সিক্রেট। সেবা প্রত্যাশিদের অসহায়ত্ব কাজে লাগিয়ে মাসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য চলে। এরমধ্যে নামজারি, নাম সংশোধনসহ (ক) তালিকা (খ) তালিকা খাস সম্পত্তি, অর্পিত সম্পত্তি এগুলো গেজেট দেখে (খ) তালিকা সম্পত্তি অবমুক্ত হলেও পাট ভি,পি দেখিয়ে ভুক্তভোগী জনসাধারণের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। অপরদিকে (ক) তালিকার খাস অর্পিত তালিকার দাগ নাম্বার থাকলেও সেটা আংশিক আপত্তি বলে গ্রাহকের নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন এসিল্যান্ড সাদিয়া চক্র। এই অফিসের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে আকড়ে থাকার পাশাপাশি অন্য কোথাও বদলি হলে আবার টাকা পয়সা খরচ করে বদলী হয়ে আসেন কোতোয়ালী রাজস্ব সার্কেলে। সবাই বলে এই অফিসে মধু আছে। এসিল্যান্ড সাদিয়া বিনতে সোলায়সান কোতোয়ালী রাজস্ব সার্কেলে যোগ দিয়েই গড়ে তুলেছেন ঘুষের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এখান থেকে অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। এরই মধ্যে অফিসের অনেকেই ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। ভূমি-সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যা সমাধানে পকেট কাটা হচ্ছে ভুক্তভোগী সেবা প্রত্যাশীদের। এমন হাজারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোতোয়ালী ভুমি অফিসে সেবা নিতে আসা এমন একজন সেবাপ্রত্যাশীর সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, এখানে ইট পর্যন্ত ঘুষের সাথে জড়িত। টাকা ছাড়া কোন ফাইলে স্বাক্ষর দেননা এসিল্যান্ড সাদিয়া। ঘুষ চাওয়া ও গ্রহণ করায় তার লজ্জা নেই বলেও তিনি জানান। ব্যাপক তথ্য অনুসন্ধানে আরও বেশ কয়েকজনের নাম উঠে আসে তার মধ্যে এসিল্যান্ড সাদিয়ার ডানহাত কথিত উমেদার মামুন অন্যতম। কে এই মামুন? যিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। অনুসন্ধানে জানা যায় এসিল্যান্ড সাদিয়ার ছত্রচ্ছায়ায় উমেদার মামুন ঘুষ বানিজ্যে সেবা প্রত্যাশিদের কাছে এক দানব মূর্তিমান। মামুন বিগত পতিত সরকারের আমল থেকেই ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। উমেদার মামুন অদৃশ্য ক্ষমতা বলে ঢাকা ডিসি অফিস নিয়ন্ত্রণ করে থাকত বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। তাছাড়া প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় উমেদার মামুন ঢাকা শহরের সকল ভুমি অফিসে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে উমেদার নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কোতোয়ালী রাজস্ব সার্কেলে এসিল্যান্ড সাদিয়া ও কথিত উমেদার মামুনের ঘুষের রেট নির্ধারিত ছিল। তবে কিছুদিন আগে দৈনিক সোনালী খবর পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর এসিল্যান্ড সাদিয়া তার ক্ষমতাবলে ঘুষের রেট আরো বাড়িয়ে দেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, ঘুষসহ সব অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ নতুনভাবে বৃদ্ধি করে নির্ধারণ করে দেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) সাদিয়া বিনতে সোলায়মান নিজেই। তিনি নিজেই কাজের ধরন ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী ঘুষের হার বৃদ্ধি করে দেন। পদ অনুযায়ী ঘুষের টাকার ভাগ কে কত পাবে সেটাও নির্ধারণ হয় তার সিদ্ধান্তে। আর এসব লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি উমেদার মামুনকে দায়িত্বও দিয়েছেন সাদিয়া বিনতে সোলায়মান। তারা তাদের দুর্নীতিতে দম্ভোক্তি দেখিয়েই চলেছেন। দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে উমেদার মামুন বলেন নিউজ করে কোন লাভ নাই। টাকা যা কামাই হয় সব মহলেই যায়, সবাই টাকা পায়। তাই কিছুই করতে পারবেন না। এই টাকা কতটা উপরে যায় আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। উমেদার মামুন বলেন আরে মিয়া টাকা কে না খায়, ভুমি উপদেষ্টাও টাকা খায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নামজারি কেস নং ৪৭২৭ ২৪/২৫ সংশ্লিষ্ট এই নামজারি জমা ভাগ কেসটি সর্বশেষ রেকর্ড পর্যালোচনা করে সরকারি কোন স্বার্থসংশ্লিষ্ট না থাকায় ইউনিয়নভূমি সহকারী কর্মকর্তা ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের লক্ষ্যে মঞ্জুর করার জন্য প্রস্তাব প্রেরণ করেন । কিন্তু দুর্নীতিবাজ সাদিয়া চক্রটি মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে এবং বিষয়টি ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে মৌখিক ভাবে অবগত করলে কেসটির সম্পর্কে জানতে চাইলে এসি ল্যান্ড কোতোয়ালী সাদিয়া চাহিত ঘুষের টাকা না পাওয়ায় বিভাগীয় কমিশনার-কে অসত্য তথ্য দিয়ে জানান নামজারি কেসটি কোড অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি (সি, ডাব্লিউ)। দুর্নীতিবাজ এসিল্যান্ডের ভাষ্যমতে অর্থাৎ সরকারি স্বার্থ বা সরকারি সম্পত্তি । আবেদনকারী নাছির উদ্দিনের বক্তব্য ও রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, সি.এস, এস.এ, আর.এস ও সর্বশেষ মহানগর রেকর্ডে সি ডাব্লিউ হিসেবে খতিয়ানভুক্ত হয়নি। যেহেতু ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি সেই মোতাবেক ব্যক্তি মালিকানার নামে পৃথক খতিয়ান ভুক্ত হয়েছে। কিন্ত ঘুষের টাকার কারনে যা আটকে দেন এসিল্যান্ড সাদিয়া।
কোতোয়ালী ভূমি অফিসে ঘুষের টাকার ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে আছেন উমেদার মামুন। অফিসের ভেতরে কাজ করা একাধিক উমেদারের মাধ্যমে তার কাছে টাকা জমা হয়। জানা যায়, কোতোয়ালী ভূমি অফিসে যত খারিজ হয়, তার বেশির ভাগই উমেদারদের মাধ্যমে হয়। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু করেন অফিসের কর্মচারীরা আর কিছু করেন ব্যক্তি নিজে। এসিল্যান্ড সাদিয়ার ঘুষের রেট বেশি থাকায় লোকজনের কাছ থেকে টাকা বেশি নিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিটি আবেদনে আবেদনকারী বা তার নিকটজনের মোবাইল নম্বর উল্লেখ থাকে। কতৃর্পক্ষ এই সূত্র ধরে তদন্ত করলেই কোন খারিজ কার মাধ্যমে হচ্ছে ও কী পরিমাণ টাকা নেওয়া হচ্ছে-বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে। হয়তো কিছু লোক ভয়ে কিছু বলতে চাইবেন না, তবে অনেকে সত্য বলে দিবেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version